Tuesday, December 18, 2012

এই সংখ্যার কবি- অকাল প্রয়াত শামীম কবীর





শামীম কবীরের জন্ম ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল  বগুড়ার কাহালু গ্রামে নানা বাড়িতেশৈশব থেকেই শামীম কবিতা অনুরাগী রংপুর ক্যাডেট থেকে মাধ্যমিক এবং রাজশাহী সরকারী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পর প্রথাগত পদ্ধতির পড়ালেখার প্রতি অনিহার কারণে একাডেমিক পড়াশোনার সাথে সম্পকের্র ছেদ ঘটেকিছুদিন বিরতির পর বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে গ্রাজুয়েশনের জন্য ভর্তি হলেও তা শেষ করেননি শামীম এবং সেসময়ে লেখালেখির সাথে আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েননব্বই দশকে লিটল ম্যাগাজিন-কেন্দ্রিক ঢাকার সাহিত্য জগতের সাথে শামীম   প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেননদী, প্রানত্ম, দ্রষ্টব্য, রূপম, একবিংশ ইত্যাদি লিটল ম্যাগাজিনে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতব্যক্তিগত জীবনে শামীম খুব শানত্ম প্রকৃতির হলেও ভেতরে ভেতরে ছিলেন প্রচন্ড অস্থির  কবি বন্ধুদের সাথে তাঁর  বোহেমিয়ান জীবন-যাপন  পরিবার ও সামাজিক দৃষ্টিকোনে অগ্রহণযোগ্য ছিলশামীমের কবিতা নব্বই দশকের অন্যতম বৈশিষ্ট্যসূচকwbR¯^Zvq ঋদ্ধ নাগরিক ব্যক্তির- নৈঃসঙ্গ্য, যন্ত্রণা, মনসত্মাত্ত্বিক ব্যাধি আর বিচ্ছিন্নতাবোধের চর্মহীন কঙ্কাল যেন শামীমের কবিতাতবে লোকজ ও স্থানিক উপাদানও তাঁর কবিতায় অনুষঙ্গ হিসেবে বহুল ব্যবহৃততিরিশের কবিদের ধারাবাহিকতায় বাংলা কবিতায় আধুনিক নিঃসঙ্গ মানুষের যে নৈর্ব্যক্তিক উপস্থিতি; শামীম কবিতায় তারই ব্যবচ্ছেদ করেছেন মর্গের দমবদ্ধ ঘরেসাড়ে চব্বিশ বছরের ¯^ívqy  জীবনের প্রায় অনেকটা সময়জুড়ে কাটিয়েছেন কবিতার অনুষঙ্গেলেখার পাশাপাশি শামীম ছবি আঁকতেন এবং চমৎকার গান গাইতেন
দ্রষ্টব্য থেকে শামীম কবীর সমগ্র বের হয় ১৯৯৭ সালে২০০৯ এর বই মেলায় অ্যাডর্ন পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল -নির্বাচিত কবিতা :শামীম কবীর





শামীম কবীরের কবিতাগুচ্ছ




ভোরবেলার স্বপ্ন নিয়ে ভাসা




যা কিছু প্রত্যয় আজ ভেস্তে যায় আধখানা পা

জীবন যা কিছু ধরে রাখে

এবং যা কিছু সাঙ্গ করে

রেখে যাই পাহাড়ী মদের ধারা

আজ রেখে ঢেকে যাই

অন্যদিকে শোঁ শোঁ শোঁ বাতাস কাঁপে

মনে হয় ভ্রাতার হাতে যে ভগ্নিধাম

তার কথা



এই যে এতোটা পথ

এসবই নকল

তবে পড়া যায় মৌসুমী সাপের সাঁটলিপি

আমার প্রত্যয় আজ ভেসে যায় আধখানা পা

   খণ্ড ধাবনের যতো সুরেলা প্রতীক ছিলো

ভুলে গেছি ঢলের পুরান ভাষা

কী এক ভাষার লোভে বেঁচে থাকি

কী এক প্রত্যয় আজ ভেস্তে যায় আধখানা পা



যা কিছু সকল শংকা যা কিছু স্বচ্ছল

জীবনের কে কোথায় ঊষর মলের ভাণ্ড ত্যাগ করে

উদরে পুরেছে কালো গোলগাল অপোক্ষার বীজ

তার ধাবনাঙ্ক মনে করি

অন্য আধা তর্কে বেঁচে থাকে

মাথা ভেদ করে আছে শীতের গহ্বর

ঐ পথে ঝেড়ে ফেলি বিদেহী ভষ্মের কারুকাজ

তরল আগুনে ঢাকা মেঠো পথ

তাক করা জীবনের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া

                       সোজা



ও বক্রল সরল চাকার তুমি অণ্ডকাম

আর ভেস্তে যাওয়া আধখানা ভরের সহগ

উলো আমন্ত্রণক্রমে আমি আজ সীমায় এসেছি

যাহার প্রত্যয় আজ ভেস্তে যায় আধখানা পা

সারাটা গায়ের সঙ্গে প্রলেপিত দাফন পোড়ার ঘ্রাণ

দিগ্বিদিক ঘ্রাণের আঘ্রাণে

ভেসে যাওয়া পৃথিবীতে একা আছি

পরমাংশ শোধনের কাটা ছেঁড়া সৈকতশালায়

কী এক আকুল লোভে বেঁচে থাকি ছদ্ম প্রতিদানে



এমন আতপ মৃত্যু মাটি শুধু

মৃত্তিকাই পুঁতে রাখা জানে






দেহ পেয়ে গাইবার জন্য গান




অস্থায়ী



সারাক্ষণ হাতে চাই চাই গানের বাকশো

 কতো রঙের ঢঙের আকৃতিঅলা ফাটাফাটি গান

আর সাবেক প্রভুত নামে শৌচপর্ব সেরে

দেহ খুলে ফেলে তারা বাদসঙ্গী

সদ্য হলো তাদের তা পরিচয় ভুল



মনে করি ভুল আমি তাই ভুল করে সকলেই

সহজে সহজ ভুলে ভরে যায় রাফ খাতা

মাথাটি গোবর ভরা যদি হয় আর

সোজা যেও মুনমুন ফার্মেসী

এবং সঠিক মাপে মাপে খাপে খাপে

চাঁদ ভরে দেবে তারা

তবে আমি যা কল্পনা করি

নষ্ট হলে পুনরায় সারাবার সহজাভ

পথ থাকা চাই



আকৃতি বিশেষ নয়

যখন তা মনে হয় তাই হয়

প্রথাভাঙ্গা দেহ পেয়ে গাইবার জন্য যা যা গান

যে সবই সতেজ হবে

কাঁখে বাকশো ও আকণ্ঠ পান

সারাক্ষণ হাতে চাই গানের বাক্শো খান



স্থায়ী



ফের ওঠে ভেসে ভেসে খড়ের ভেতর বুনোফল

বৈশ্যদের অধিকারে আরও দিন দিন

দিবাগত রাত্র বেলা বিকিরিত কাটা তান শুনে

পুড়ে যেতে যেতে সোনাভান

বলেছিলো এই চাঁদ আঁটো হয় গলে

অন্য একটা ছোটো বদলে দেবে?’ বলে বলে

তবু আমি চাঁদে চাঁদে গান নিয়ে আরও যাবো চলে

Perfect ice, when they call, O Machine



  
কচ্ছপের খোলার নিচে


 কচ্ছপের খোলার নিচে কাটালাম, দুইহাজার বৎসর, তারপর আজ, মাথা বের করব আমার মনে পড়ছে সেই বটগাছটির কথা, যার তলায় আমি, পড়ে আছি, তার, বিশাল প্রসন্ন ডালপালা ছড়ানো, চূড়াটি তো অনন্ত উঁচুতে উঠে গেছে, না, তা হয় না, কিন্তু ভেবে, আমার বুকে আনন্দ চমকালআমি এর বিশালত্ব দেখে আত্মহারাযেবার প্রথম, এ অঞ্চলে আসলাম, চারদিকে কেবল কমলারঙের কর্কশ, ধুলোটে মাটির, ছোটো বড় টিলা আর গড়ের বেষ্টনিঅলা, একরের পর একর, ধানতে, উঠান, আংড়া, তেতালা মাটির ঘর, প্রতিটা ঘরের পাশে একটা করে তেজপাতাগাছ, নদীনালা, খাল আর মাঠশেষে, গাড়িয়ালের সুলিখিত, স্বপ্নপ্রকোষ্ঠ, সূত্রশালী চাকার ঘর্ঘরস্পৃষ্ট বহরের নিচ থেকে, চাকচাক গোধূলি, আকাশ, অস্তরেখা ইত্যাদির সম্মিলিত, রহস্য ও লোভ ঠিকরে পড়া, সাতাশশোটি গ্রাম, তার মধ্যে, মহাপ্রাণ এক বৃদেখে, আমি, কিছুকাল তন্ময় তার প্রেমে, তারপর আত্মহারাআমি ঘুরেফিরে, এসে, এর নিচে রোদ পোহাতে লাগলাম, প্রতিদিনপ্রতি সন্ধ্যাবেলায়, তার আবছা, ছাতার শীর্ষের দিকে, আমার ছোট্ট, বিষণ্ণ দেহ, তুলে ধরে বলতাম, চমৎকার, আজ যাইএদিক সেদিক, ঘরে বেড়াতাম, তারপর ধীরে ধীরে, চেনা হয়ে গেল, বাগানের আলো লাগা কাচে, দিনশেষের আনন্দিত মুখ, দেখতে দেখতে, শেষ চা, টাটকা পোস্টার, টিনের হরিণ, সিফিলিসের জীবাণু, পুলিশের ভ্যানসব, চেনা হয়ে গেল, সবাই





আমার ঘর  


এখন সময় হলো

আমার লাল ঘোড়ার গাড়িতে ফেরার

আমি দুপায়ের হাড় বাজিয়ে ফিরবো

আমার ঘরে

না কোনো ফুলের ঝাড়

কেবল মৃত্যু

আমার ঘরে কী সুন্দর সাজানো




 কাঁপন



বৃত্তের সূত্র :

বৃত্তের পাশ ছুঁয়ে থাকা হাত

আলগোছে সরে এসে একটু একটু কাঁপলো



তাকে কী বলা যায়



আমি বাহান্নজন বালকের মুখ তৈরি করি

আদলে আদলে বিদ্যুৎ স্পৃহা চমকায়

আর হাত নিচু করে যখন সরে আসি

সন্ধ্যার সুবাস রেখে চলে যাওয়া রুমালের

অগোচরে জীয়ে থাকা অজস্র কাণ্ডের সাথে

গলাগলি আর খাড়া থাকবার উন্মাদনা

শেকড়ের গুপ্ত স্ফিতির চেয়েও

উত্তুঙ্গ হয়ে ওঠে



আমি এই পৃথিবীর নই



গোলকের সূত্র :

কব্জা খুলে ছুটে ছুটে যাওয়া প্লীহার গন্ধ

ভরাপেট উগরে গিয়ে বিকেলের হিম মাখানো রোদ

গায়ে মেখে ক্রমশ উদাস হয়ে যায়



যা ভাবায়

যা কাতর করবার জন্য আনাগোনা করে

কবিতাকে আঁকড়ে থাকতে হয় এক ছোটো

    পীত রঙের হুকের সাথে

আর হাত ফসকে পড়ে যাওয়া কাঁধের গল্প

আজ মনে পড়ে যায়



যার কাছে গচ্ছিত রাখার বেদনা

এক বোতল উগ্র জেদ আর পাশবালিশের

কান ছুঁয়ে থাকা স্বপ্নের আঁকাবাঁকা রেখা

আজ হয়ে যায় ক্ষণে ক্ষণে

যার কাছে আমার লাল ঘোড়ার গাড়িতে

ফেরার সময় হয়

হয় হয় হয়



সেই গন্ধে আকুল চেতনার একপাশ বয়ে নিয়ে যাওয়া

এখন এই বিলয়ের বিনির্মাণ কালে



বৃত্ত ও গোলকের সমন্বয় সূত্র :

ডাক পাড়ে ডাকে

খালি ডাকে

একটু একটু ঠুকরে বেড়ানো ঠোঁটের পিনবিন্দু

স্থায়ীভাবে একবার বসতে চায়

তোমার অন্দরের ভিতর



ঠিক য্যানো আমি ভুলে গেছি

অথচ রাজ্যের বিস্ময় চিহ্ন মাখানো ছাতুর পিণ্ড

আকাশ জুড়ে করতাল বৃষ্টির সাথে ঝরে

ঠিক য্যানো আমি ভুলে গেছি



ক্ষুধা আমি ভুলে গেছি

মেশিনের বরপুত্র আমি




 মুক্তি


 আমার ভূমি কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিমাথার ওপর আকাশপায়ের নিচে আকাশ সামনে ডানে পেছনে বাঁয়ে আকাশএই রকম আকাশময়তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি ভূমি কাঁধে নিয়েবহুস্তর শিলা খনিজ কাদা আর খড়িমাটির গড়া একফালি ভূমিঅনেকদিন আগে হাঁটছিলামতারপর কখন য্যানো এইভাবে দাঁড়িয়ে পড়েছি



কাঁধ জমে গ্যাছেবহুবার কাঁধ বদল করেছিদুকাঁধেই কড়া দাগএকটুকু ভূমির ভারও অসাধ্য মনে হচ্ছেআরেকবার কাঁধ বদল করলামতাতে একটু আরাম হয় এরপর সামনে মনোযোগ করে মেঘেদের রঙ বদল গলে যাওয়া আর বিদ্যুতের লাফালাফিদেখলাম অনেকণঠিক আলো নয়, এক রকম আভার মধ্যে দাঁড়িয়ে এসব দেখতে দেখতে ফাঁকাবহু দূরে একটা ছুটন্ত ধুলিকণার পুচ্ছ খুব জ্বলছেসবদিকে অনেকগুলি তারা টিপ টিপ করছেদেখতে দেখতে এইসবের মধ্যে দৃষ্টি ক্রমশ শূন্য হয়ে আসলোএকদিকে অনন্তর তাকিয়ে রইলাম আর কিছুই ভাবলাম নাহঠাৎ একটা উল্কা একেবারে পাশ দিয়ে ছুটে চলে যায়ঘোর কেটে যায় তার ঝাপটায়চমকাইতারপর একটা ঝাঁকি দিয়ে আলগোছে কাঁধ থেকে ছুঁড়ে ফেল্লাম ভূমি খণ্ডটি







 হে দরোজা

  
হে দরোজা, গোথিক খিলানে আঁটা সুপ্রাচীন পথের দরোজা

কী কারণে পেতে হয় এমন প্রতীক্ষার সাজা

আকাশে নিশ্চল মেঘ, আবিষ্ট চাঁদের কুহেলিকা

উজ্জ্বল দুচোখ তুলে চেয়ে দ্যাখো একনিষ্ঠ বেদনার টিকা

সমুজ্জ্বল আমার কপালে

কী কারণে হে দরোজা কুয়াশার অধিক আড়ালে

এইভাবে নিষ্প্রাণ -থেমে যেতে হয় প্রতারক

পথের প্রান্তে এসে, হাঁটু জলে বৃদ্ধ ধ্যানী বক

ঘনভার অন্ধকারে হিরন্ময় নত্রের রথ

সীমাহীন প্রতীক্ষার মালা গাঁথে নির্জীব -শ্লথ



আলোকের গতিবেগে দীর্ঘপথ প্রায় উড়ে উড়ে

এসেছি তীরের মতো অন্তহীন অন্ধ চক্র ফুঁড়ে

সঙ্গী সাথী অনেকেই ছিলো, মধ্যপথে

ঝরে গ্যাছে, রে গ্যাছে তারা-অভ্রভেদী অগ্নির শপথে

ও-পারে যাবার দীক্ষা নিয়েছিলো যারা

আমি শুধু ধুঁকে ধুঁকে অতি কষ্টে স্বপ্নগর্ভ অসীম সাহারা

পাড়ি দিয়ে শুধুমাত্র তোমারি প্রদত্ত ভরসায়

এতো দূর এসেছি, তবুও ক্যানো হায়

গ্রহণ করোনা-

আমিতো অন্ধের মতো কোনোদিনই কারুর করুণা

প্রার্থনা করিনি কিংবা সীমাবদ্ধ জলে

কাটিনি সাঁতার, শুধু নিজের দখলে

যেটুকু উর্বর ভূমি ছিলো

একাগ্র চাষার মতো-প্রতিপার্শ্ব ব্যেপে এক তিলও

অচষা রাখিনি মাটি তার

[এবং দুচোখে আঁকা ছিলো প্রতিবিম্ব দরোজার]



এ পারে প্রতীক্ষারত অথচ হে গম্ভীর দরোজা

তুমি শব্দহীন আর দূর্গ প্রাচীরের মতো সোজা

ক্যানো রোধ কোরে আছো পথের সীমানা

গ্রাস করো, আমাকে গ্রহণ করো, ও পাশের যে কোনো অজানা

আর সম্পূর্ণ নোতুন পথে যেতে দাও,-হায়

পরিত্যক্ত-রেখে দিলে ক্যানো এইপাশে কুয়াশায়



আমি কি অস্পৃশ্য খুব-হীন গোত্র ইতর সমান

অথবা জঘন্য অপরাধী-মূর্তিমান

হে দরোজা কী কারণে স্পর্শ তুমি করোনা আমার

এইভাবে ফেলে রাখো শুধু কী অসহ্য প্রতীক্ষায়

হে দরোজা পথ ছাড়ো, বিষ কপাট খুলে তফাতে দাঁড়াও

সামান্যই আর পথ আছেযেতে দাও, যেতে দাও



তবে কি সূচনাতেই ছিলো কোনো ক্ষমাহীন ভুল

যাত্রার শুরুতেই ছিঁড়ে গ্যাছে গন্তব্যের মূল



হে দরোজা তোমার গহীনে আরো যাবোতুমি খুলে যাও

আর যদিবা অনড়ই থাকো তবে অন্ততঃ বোলে দাও :

কী কারণে পথের প্রান্তে এসে এরকম থেমে যেতে হয়

আর, কোন্ অপরাধে বলো মূল্যহীন হোয়ে যায় সমূহ প্রণয়-

তা-হোলে প্রারম্ভ থেকে পুনরায়

শুরু করা যেতে পারে পথক্রমা গভীর নিষ্ঠায়



আকাশে নিশ্চল মেঘ, আবিষ্ট চাঁদের কুহেলিকা

নিথর দুচোখ তুলে চেয়ে দ্যাখো-কী গভীর বেদনার টিকা

দগ্ধ আমার হৃদয়ে

আমাকে যেতেই হবে অন্যপ্রান্তে হে দরোজা তোমার অন্তর্ভদী হোয়ে

সুতরাংহে গম্ভীর কঠোর দরোজা দাও

বোলে দাও-কী কারণে পেতে হয় এই দীর্ঘ প্রতীক্ষার সাজা

আমি কি অস্পৃশ্য খুব কিংবা মাহীন পাপী-বিনষ্ট জীবন



হে দরোজাবোলে দাও, কোন পাপে ব্যর্থ হয় এইভাবে-সমগ্রভ্রমণ





ভাঁজ  

  
অকস্মাৎ আমি য্যানো দেশাত্মবোধক

দূরন্ত হাওয়ার ঘোরে ঘূর্ণিমান হই

ইতিহাস ঘটে চলে নানান দশার

আর কিন্তু যেতে যেতে পুল সংক্রমণে

মনে পড়ে এইদেশে হাওড়ে বাওড়ে

ফুটে থাকে লাল বউ ভ্রমর ও চখা

চক্ষু ছুঁড়ে মেরে শূন্যে প্রতিনৃত্য করে

ঘূর্ণি ওঠে দেহে ঘূর্ণি ওঠে চিটাধানে

এবং বাঘেরা বসে সিংহাসনে বনে

বনতো ফ্রীলের মতে সমুদ্রে বিলোপ

দূরন্ত হাওয়ার ঘোরে লালধুলা ওড়ে




 ও চাঁদ


 যে চাঁদ মাস্তুলে বাড়ি খেয়ে ভেঙে গ্যালো

যে চাঁদ সাগরে টুকরো টুকরো হয়ে

                             রে পড়লো

যে চাঁদ সমুদ্রের নিচে শুয়ে আছে

                           খণ্ড বিখণ্ড হয়ে

সে চাঁদ তুমি নও

তুমি তার প্রেতাত্মা







বিশেষ ফাটল


 এ বাড়িতে আমি থাকি আমি থাকি দেয়ালের কাছে

এ বাড়িতে বহুদিন থেকে আমি দেয়ালের মতো

দেয়ালের মতো আছি আমি আছি দেয়ালে জড়িয়ে

আমার শরীরময় দেয়ালের সহস্র ফাটল

আমার শরীরময় দেয়ালের সহস্র ফাটল

আমার শীররময় দেয়ালের সহস্র ফাটল

ফাটলেরা রোজ রাতে মাটিতে মাটির মতো শোয়া

দেয়ালের পাঁজরায় বটশিশু শেকড় ছড়ায়



বাড়িতে পিপঁড়ে আছে, আমি আছি দেয়াল রোয়েছে

বাড়িতে পিঁপড়ে আছে দাঁতাল হাতির মতো তারা

দাঁতাল হাতির মতো ফুটো খোঁজে আমার হাঁটুতে

আমার হাঁটুতে  ফুটো খোঁজে ফুটো খোঁজে দেয়ালের

আমিও ফাটল খুঁজি বিশেষ ফাটল দেয়ালের

[কখনো কি দেয়ালের বিশেষ ফাটল থাকে কোনো]

পিঁপড়ে ফাটল খোঁজে আমিও ফাটল খুঁজি খুঁজি

আমিও পিঁপড়ে হোয়ে খুঁজি এক বিশেষ ফাটল



যদিও শরীরময় দেয়ালের অজস্র ফাটল

আমার শরীরময় দেয়ালের সহস্র ফাটল

তবুও পাই না খুঁজে সেবিশেষ গোপন ফাটল

কখনো কি দেয়ালের বিশেষ ফাটল থাকে কোনো





অবলা সংলাপ


 কী যে ঘোর লাগে কা‎‎হ্নু বাশি শুনে দুর্বল গাছের ডালে আমার যে প্রাণপাখি বাঁধা

আহা আগাই পিছাই শুধু হৃদপিন্ডে খুন্তি ছ্যাঁকা পুরান কাঁথার নক্সা কত আর চক্ষে

সয় জানালায় টিয়া ডাকে তীরন্দাজ কোন সে দূর থেকে বুকে মারে বাণ আমার

চোখের জলে বন্যা নামে বুঝি আমি কি ফ্যালানি ছাই প্রাণসখা আমাকে পোছে না

কতজন আসে যায় হাট ভাঙে করল্লার লতাটাও কঞ্চিমাচা জড়িয়ে ধরেছে ওই কলাঝারে

হাঁটে বুঝি কেউ মর ছাই আলতা গাই ওটা কী যে ভুল নিঁদ নাই গলায় শাদা নলা নামতে

না চায় হায় প্রাণনাথ কোন বনে ঘোরে ঘরে শান্তি আমার নাই আমার যে প্রাণে বিষ কেউ

জানলে সর্বনাশ হবে ওলো সই তোকে কই কা‎‎হ্নু পিয়া এলে বলে দিস পোড়ামুখি কলস

নিয়ে যমুনা গিয়েছে


শামীম কবীর

  
খুব ক্রুর মুখোশের মতো মনে হয় এই নাম অতিকায়

রূপালী  তিমির  মতো- আমার মর্মমূলে এই খুব নিবিড়

আপন নাম নিদ্রিত রেখেছে এক বিশুদ্ধ আগুন (তন্দ্রায়

নিবে গ্যাছে তার সব তুখোড় মহিমা)-এই প্রিয় সশরীর

নাম এক দাঁতাল মাছির মতো অস্তিত্বের রৌদ্র কুঁরে খায়

রাত্রিদিন; আষ্টেপৃষ্টে কাঁটাতার হোয়ে আছে- শামীম কবীর

এই তুচ্ছতর নাম : গোপনে,ত্বকের নীচে খুব নিরুপায়

এক আহত শিকারীর নামের মোহন ফাঁসে জড়ায় তিমির



ইতিহাসে অমরতা নেই; পরিবর্তে রাশি রাশি বুলেটের

দক্ষ কারুকাজ করোটিতে, দগ্ধ লাশময় দীর্ঘ উপত্যকা

আর নীলিমার বোঁটা থেকে অনর্গল-নির্ভার নি:স্বদের

 জাতীয় সঙ্গীত ঝরে পড়েক্যাবল কুচক্রী এই নাম- পাকা

নিকারীর মতো রোয়েছে অমর য্যান, আমার সকল পথে

অয় জালের ব্যুহ কোরেছে আরোপ কোন দুর্বার শপথে




এই ঘরে একজন কবি


 এই ঘরে  একজন কবি আছে রক্তমাখা গালিচায় শুয়ে

কুয়াশার মতো-তার নিদ্রামগ্ন ভাসমান চোখে ধীরলয়ে

শীর্ণ এক নদীর প্রতিমা ফ্যালে সুরময় ছায়া, শতাব্দীর

শুদ্ধতম শিলাখণ্ড শিয়রে তার-ঠিক একগুঁয়ে

ধীবরের মতো: ছিন্নভিন্ন-ছেঁড়া জালে কৌশলে মরা নদীর

শ্রোণী থেকে অপরাহ্নে রূপালী ইলিশ ছেঁকে নেবে;পঁচা ঘা-য়ে

গোলাপের মধু ঢালা-অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে য্যানভীষণ অস্থির

হাতে সে ক্যাবল বিষন্ন খুঁড়ে চলে শব্দের গোপন তিমির



কবির আঙ্গুল থেকে অনর্গল রক্ত ঝরে আর মূর্তিবৎ

অন্ধকারে পড়ে থাকে সে-ক্যামন মর্মন্তুদ অদৃশ্য বল্কলে

ঢেকে অস্তিত্বের তঅবশ্য মাঝে মাঝেই বদ্ধ ঘরময়

গলিত বাতাস কাঁপে-অন্তর্গত সজীব গর্জনে:বাঁধা গৎ

ভুলে গিয়ে-নিদ্রিত কবির বীণা সহসা কী প্রখর আদলে

গড়ে সুরের প্রতিমা, অথচ খোলে না তার অন্ধ চক্ষুদ্বয়।।




যে গ্যাছে, সে অন্য কেউ

 যে গ্যাছে, সে -অন্য কেউ, আমি নই

এতো তাড়াতাড়ি আমি যাবোনা এখান থেকে:

এতো তাড়াতাড়ি ক্লান্ত এই অবেলায়;

যে গ্যাছে, সে-অন্য কেউ আমি নই



কোকিলের ঘুম ভাঙ্গবার অনেক আগেই, অসমাপ্ত

যে বসন্ত চোলে গ্যাছে দৃষ্টির আড়ালে,

অন্যকোনো সীমিত বাতাসে-

সে আমাকে কানে কানে বোলে গ্যাছে, প্রতীক্ষায় থেকো:

---আবার শুকোবে জল, হলুদ পাতার শব্দে

সচকিত হবে বনভূমি গীর্জার চূড়োয় গাঁথা

ভগ্ন ক্রুশে সাদা চাদরের মতো

                        মে যাবে মলিন তুষার, একজন

অবসন্ন পাদ্রী খুব কোমল আলোয় ঢাকা

চূড়ো থেকে পাঁচবার বাজাবেন তীব্র ঘন্টাধ্বনি;

ভোর ঘুমে-তোমার চোখের কোনে অকস্মাৎ

                       জ্বলে উঠবে সঞ্চিত বারুদ

কোনো একদিন ফের-বসন্তের চিঠি নিয়ে তোমার অচেনা

এক সম্পূর্ণ নোতুন গান গেয়ে উঠবে-তোমার বুকের মধ্যে

                         নিদ্রামগ্ন বিমূর্ত কোকিল;

শুধুমাত্র-পৃথিবীর শেষতম ভোরতক প্রতীক্ষায় থেকো---



আমিতো এখনো আছি সেই বসন্তের জন্যে অনন্ত উন্মুখ প্রতীক্ষায়



আমি কি অপর কোনো ফাল্গুনের কোলাহলে মগ্ন হোতে পারি?

অন্য কোনো কোকিলের গানে আমি হবোনা মাতাল

অসমাপ্ত-সেই বসন্তের দ্যূতি চোখে নিয়ে, তারপরে যাবো আমি,

                                                   এখনতো নয়



সমুদ্র দেখিনি আজো; শুধুমাত্র- সমুদ্র শঙ্খের

খুব ডোরাকাটা যোনিতে ঠেকিয়ে কান

                 তীব্র এক টাইফুন বোয়ে গ্যাছে সমস্ত শরীরে

এক অসফল নাবিকের দৃঢ় হাতে হাত রেখে কথা দিয়েছিলাম :

আমিও আঁধার রাতে সামুদ্রিক ফ্যানা নিয়ে প্রবাল দ্বীপের

খুব গোপন রত্নের ঘরে হানা দেবো, একটানে ছিঁড়ে দেবো

মাস্তুলের- সমস্ত জালের মতো কীর্ণ দড়াদড়ি



বৃদ্ধ নাবিক আজো উপকূলে বোসে আছে-

                                    তীব্র দৃষ্টি, একা, হাতে ভাঙ্গা হাল

সূতরাং-সমুদ্র-শঙ্খের পেটে না ঢুকেই পালাবোনা আমি--

এতো তাড়াতাড়ি আমি যাবোনা এখান থেকে,

এই অবেলায়; অন্য কেউ চোলে গ্যাছে,

আমি নই; যে গ্যাছে, সে- অন্য কেউ

পূর্বপুরুষের খুব মাটি মেশা জৈবসারে ভীষণ উর্বর

                                   যে সমতল জমি--

সেখানে গহন এক তাজা বীজ পুঁতেছি গোপনে, নির্ঘুম রাতের শেষে

ঢেলেছি অঝোর বৃষ্টি, সোঁদা ঘাম, গাঢ় রৌদ্রকণা---

প্রকৃত স্বপ্নের মধ্যে

সে আমাকে বোলেছিলো, সোনালী ফসল দেবে, আমাদের

আঁধার বাড়িতে ফের জ্বলে উঠবে

শস্য গন্ধী নবান্নের আগুন



সবেমাত্র নিদ্রিত বীজের পেটে কান রেখে- অঙ্কুরোদগমের

খুব অভ্রান্ত মিহিন শব্দ শুনেছি ক্যাবল

তার খুব বেড়ে ওঠা ফসলী শরীর আর

সূবর্ণ শস্যের শিষ না দেখেই চোলে যাবো আমি?

এই হিম জড় হাত-নবান্ন আগুনে সেঁকে, তারপরে

      যেতে পারি, যাবো:

আঁধার কাটার আগেই-যে গ্যাছে, সে- অন্য কেউ, আমি নই

আগুনে পোড়ার ভয়ে- যে গ্যাছে, সে-অন্য কেউ, আমি নই।।



যে গ্যাছে, সে-অন্য কেউ আমি নই









জন্মান্ধের ভূমিকা 


 জন্মাবধি অন্ধ হোয়ে আছিসশরীর, এড়িয়ে ধুলোর মতো

গাঢ় রৌদ্রালোক দুইচোখেবয়েসী বটের মূলে গুপ্ত ক্ষত

দেখিনি তাকিয়ে কোনোদিন, অথবা আড়ালে থেকে নির্নিমেষ

জ্যোৎস্নালোভী নারীদের পাহাড়ী গ্রীবার ভাঁজে তীব্র অনুদিত

গোলাপ শিশু; পরিবর্তে আমার চৈতন্য স্রোতে কি দগ্ধ শেষ

নিঃশ্বাস ফেলে ছায়া হয় ইতস্তত ছিন্ন মেঘেরা; ঘুমন্ত

ঈশ্বরের মতো, মনে হয়বহুকাল পড়ে আছি জলশেষ

শুকনো কাদায়, ত্বকের নিচেও আছেও খুব গাঢ় ছদ্মবেশ



আমার গুহার বার্ণিশে সবুজ সতেজ অর্কিড প্রতিদিন

রৌদ্র খায়, বাতাসের উন্মুক্ত গালিচায় নির্ভেজাল প্রাচীন

অশথ্থের মতো ছড়ায় শেকড়; ক্যাবল স্মৃতিনষ্ট আফিমে

আচ্ছন্ন রোয়েছি বোলে, গুহার আঁধারে আমি মায়াবী পিদিমে

খুঁজি রৌদ্রের প্রতিমা, আর ক্রটিহীন জন্মান্ধতা হেতুকরি

আরাধনা নর্তকীর : নির্ভুল মুদ্রায় নেচে যদি পাই সিঁড়ি।।




 পৃথক পালঙ্কে 

(কবি আবুল হাসানকে নিবেদিত)


  তুমি ঠিক পলাতক নওআমিতো এখনো দগ্ধ তৃণভূমি

থেকে পাই উপবাসী ভেড়াদের বিক্ষুব্ধ শিং-সংঙ্কেত; তুমি

কি উটের মতো জ্বলস্ত ক্যাকটাসের জমাট জল তরঙ্গ

এখনো শুনতে চাও, নাকি ঘুমের ভেতরে শুয়েসমকামী

আর হিজড়েদের ত্রুটিহীন ব্রহ্মনৃত্য দেখবে? স্বপ্ন ভঙ্গ

জানি তুমি অক্লেশে সোয়ে নাও, তবুরাত্রির মতো নিম্নগামী

কালো জলে ভেসে যদি যায়জননীর মতো অসহায়বঙ্গ

তোমার, তুমিও তো পারবে না ঠিক এড়াতে যন্ত্রণার সঙ্গ



তোমার মর্মমূলে নিসর্গের শীর্ণ লাশ সর্বদা কল্লোলিত

শ্মশানের প্রেতী গান গায়, অরণ্য-মঞ্চে এক অন্ধ নায়ক

রাতদিন তোমার অনুকরণে করে বৃপজা,স্বপ্নাতঙ্কে

নীল কিশোরীর বুকে মোহন তোমার বাঁশি বাজেউন্মোচিত

সত্য-সম জানি সব, হে-পাতক স্বর্গের বাগান পলাতক

নও তুমি, নির্বাসিত হোয়ে আছোস্বপ্নহীন পৃথক পালঙ্কে।।







ফাঁকা

 শহরে আগুন লেগে কাণ্ড শুরু হলো

রাস্তা দিয়ে উঠে এলো ভূগর্ভের ড্রেম বেঁকেচুকে

সবশেষে কার্বনের ফ্রেম হয়ে সবকিছু বয়

কয়েক শতাব্দী পার করে দিতে

এরকম সমগ্র পৃথিবী

তার মধ্যে একা এক কাঁধ

ঘোরে ফেরে

কোনো কিছু বহনের নাই কোনো আর





আমার ঘর 

এখন সময় হলো

আমার লাল ঘোড়ার গাড়িতে ফেরার

আমি দুপায়ের হাড় বাজিয়ে ফিরবো

আমার ঘরে

না কোনো ফুলের ঝাড়

কেবল মৃত্যু

আমার ঘরে কী সুন্দর সাজানো








স্রোতে... স্যান্ড্রা! ফালি ফালি চাঁদ ভেসে যায়



একবার জাল ফেলেছিলাম গলুইয়ে বসে

তখন চাঁদ ছিলো না

আমি আবিষ্কার করতে চেয়েছিলাম পানির জীবন

ক্যামন নোনতা আর চ্যাপ্টা তার কোষতন্ত্র

আর উল্লাস রাগে কী রকম থরথরিয়ে কাঁপে তার বাড়

অথচ উঠে এলো ভাঙাচোরা

একটা দ্বীপের টুকরো টুকরো অঙ্গ রাশি

আর তাদের ভেতর শক্ত হয়ে বসা একটা

                          মৎস্য দম্পতির বাসা



স্যান্ড্রা প্রিয় মম

এই যাত্রায় আমাকে যেতে হবে বহুদূর

প্রায় অসীমের কাছাকাছি

চক্ষু কর্ণ জিহ্বা নাসিকা ত্বক আর

                         সমুদয় অর্থ সাথে নিয়ে

আর ঝিমাই হাঁটু গেড়ে রাতের পর রাত

যেখানে ঢেউ ছিলো এখন সেখানে শুধুই জ্যোৎস্না

সাঁতার কেটে কেটে ক্লান্ত হয় স্রোতের ওপর

  জাল থেকে একটা একটা করে খুলে

সমস্ত দ্বীপের টুকরো ছুঁড়ে ফেল্লাম স্রোতে

কিন্তু ততোক্ষণে দম আটকে মরে গ্যাছে মাছ দুটো

এতো অনায়াসে তারা মরে গ্যালো



হে স্রোতের উপর ভেসে থাকা ফালি ফালি চাঁদ

তোমরা উড়াল দাও

আমাকে যে জেগে থাকতেই হবে এই জলকষ্ট নিয়ে







দ্বীপ
 

একটা সুন্দর শাদা দ্বীপ আছেতার গায় কালো কালো ছোপআমি তার ওপর বসে চারপাশের থৈ থৈ দেখিএকটা বৈঠা আছে ছোটো কদম কাঠেরবৈঠা বেয়ে একটু একটু এদিকে সেদিকে বেড়ানো যায়চারপাশে ভেসে যায় কতো কতো দ্বীপ আরওদ্বীপগুলি বাড়ি খায়  নাআলগোছে একে অপরের পাশ কাটায়সে বসে চারপাশে দেখি আর বহুবিচিত্রি শুনি...

হঠাৎ স্বপ্নটি ভাঙার পর দেখি তেপান্তরে লম্বা খাড়া সরু এক আঙ্গুলের ডগায় বসে আছি একা পা ঝুলিয়ে আর দশ পাশে অনর্গল খালি তর্জনী উড়ছে ঝোড়ো বাতাসেসে বসে তর্জনীয় ঝড় দেখিদেখিতেছিঅনেক দূরে প্রায় দিগন্তে এক বিশাল ঢালাই লোহার কড়াই বসানোতার মধ্যে চুয়ে এসে জমা চ্ছে সমস্ত আকাশ থেকে অবিরল একধারা নীলআকাশটাকে দেখাচ্ছে এক পশলা ফ্যাকাশে হাড়ের মতো এখন





 রেডিয়োতে গান


যে মতে ধুলার স্মৃতি হলো ছারখার

সে মতে ফিরিলা তুমি ফিরিলা আবার

অশরীরী পুড়ে খাক শরীরী অনলে

আর তার বায়ুঘের ধিকিধিকি জ্বলে



সুর রে গায় সকলেআনন্দিত নয় উৎকণ্ঠিত নয় ভক্তিতে গদগদ নয় এমনকী নিস্পৃহও নয়সকলে সমম্বরে টেনে টেনে সুর করে হায় চিকন ও ভারি বহু স্বরেতাদের ভঙ্গি খুব সাদামাটা ও সাঙ্গিতিক আর উচাটন নয়স্বর মাঝে মাঝে ভেঙ্গে যায় আবার তীক্ষ হয়ে ওঠে তবে সুর অবিচল টানা টানা



অশরীরী পুড়ে খাক্ শরীরী অনলে

আর তার বায়ুঘের ধিকিধিকি জ্বলে

না দেখো চর্মের চক্ষে সেই সঙ্গপনা

নকল ঘরেতে নিশি দিবস যাপনা



সকলে গাইতেই থাকেশুধু গাইতেই থাকেএমনকি চোখের পাপড়ি নাড়াতে পর্যন্ত ভুলে যায় আর শ্বাস ফেলতেও মনে থাকে নাকেউ বসে কেউ দাঁড়িয়েকেউ উত্তরে কেউ পশ্চিমে কেউ কোনোকুনি তাকিয়ে অনর্গল গাইতে থাকেবাতাস বয়ে যায় শিরশির রেসকলের গা ঠাণ্ডা হয়ে গ্যাছেকিন্তু তারা নড়ে না চড়ে না খালি গায়



না দেখো চর্মের চক্ষে সেই সঙ্গপনা

নকল ঘরেতে নিশি দিবস যাপনা

ঝুলন্ত বিষের থলি ঘরের ভিতরে

আরও আছে সখা সখি উভকাম করে



শুধু একটানা ও বিলয় বিহীন গাওয়ার শব্দতার মধ্যে আর কিছু নেইসেই শব্দ বহুস্বর মিশ্রিত হয়ে টান টান ফাঁপা হয়ে উঠেছে আর সেই ফাঁপা নলের মধ্যে ধাক্কা খাচ্ছে গানের পূর্বাপর রেশগুলিচল্কে চল্কে যাচ্ছে তার অনুরণন



ঝুলন্ত বিষের থলি ঘরের ভিতরে

আরও আছে সখা সখি উভকাম করে

বাদ্য বাজে বদ্যি গাছে রোগের পশম

আর কাহারও নাহিকো লাজ করিছে গরম



বয়স্কদের হাঁপ ধরে নাকচিদের গলা চুলকায় নাপরনের কাপড়গুলো যে ধূসর হয়ে ঝুমঝুম রে খসে যাচ্ছে তারও খেয়াল নেইশরীর জমাট বেঁধে যাচ্ছে তারও বোধ নেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে গেয়ে চলেছে সেই একটানা মোচড়ানো সুর মোতাবেক ধীরে ঐকলয়েতাল উৎক্ষেপিতকী রকম য্যানোলৌকিক তবে একঘেয়ে মনে হতে পারেকিন্তু খুব সরল গতিতে চলছে সেটা যে বিরক্তিকর নয়আনন্দিত নয়একটানাফেঁসো



বাদ্য বাজে বদ্যি গাছে রোগের পশম

কাহারও নাহিকো লাজ করিছে গরম

অঙুলি হেলিয়া পড়ে দুধের বাটিতে

সে কেমন সাপ মরে ভঙ্গুর লাঠিতে



মাঝে মাঝে হঠাৎ বাতাস পেঁচিয়ে গিয়েই বা শিস্ ওঠেতার প্রতিধ্বনি হয় আর ফালি ফালি হয়ে যায় বাতাসকিন্তু তারা নিরুদ্ধে থাকেএকেকবার শিস্ ওঠে আর তারপর অনেক বহুক্ষণ চলে যায়আর তারা গাইতে থাকে অনড় হয়েমুখ হাঁ



অঙুলি হেলিয়া পড়ে দুধের বাটিতে

সে কেমন সাপ মরে ভঙ্গুর লাঠিতে

আর তারপরে অন্য কথা পরিচয়

কতোকাল কেটে গ্যালো হয়েছে প্রলয়



অকস্মাৎ দুম করে ব্যাটারীর আয়ু শেষ হয়



গানটির জন্য পুঁথিপাঠের লোকায়ত সুর টান ও ধ্বনি ভঙ্গিমা সহকারে সমবেত পঠন ও ধূয়াসহ বিলম্বিত গায়ন প্রযোজ্য

কৃতজ্ঞতা: নভেরা হোসেন